যকৃত ইংরেজিতে যাকে বলে লিভার। মেরুদন্ডী ও অন্যান্য কিছু প্রাণীর দেহে এই অঙ্গটি অবস্থান করে থাকে। এটি বক্ষপিঞ্জরের মধ্যচ্ছেদের নিচের অংশ। চলতি বাংলায় একে কলিজা বলে।
যকৃত কি????
যকৃত দেহের বৃহত্তম গ্রন্থি। এর ওজন দেহের মোট ওজনের ৩ থেকে ৫ শতাংশ। এটি দুটি খণ্ডে বিভক্ত। একটি ডান খন্ড । আরেকটি বাম খণ্ড। প্রাণীদেহে লিভার কিছু শরীরবৃত্তীয় কাজে জড়িত প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। গ্লাইকোজেন সঞ্চয়, প্লাজমা, প্রোটিন সংশ্লেষণ ও অন্যান্য রাসায়নিক ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ ভাবে পালন করে থাকে।
যকৃতে পিত্তরস উৎপন্ন হয়। পিত্তরস এক ধরনের ক্ষারীয় যৌগ যা পরিপাকে সহায়তা করে। বিশেষত স্নেহ জাতীয় খাদ্যের ইমালসিফিকেশন এর জন্য পিত্তরস প্রয়োজন। এছাড়াও আরো কিছু জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
যকৃতের গঠনঃ
দুই ধরনের কোষ দিয়ে যকৃত গঠিত।
একটি হলঃ
প্যারেনকাইমাল
অন্যটি হলঃ
নন প্যারেনকাইমাল
এছাড়া যকৃত প্রধানত দুই পথে রক্ত বাহিত করে।
লিভার কি কাজ করেঃ
এখন আমরা আলোচনা করব লিভার কি কাজ করে থাকে। আমাদের শরীরে আমরা যে ধরনের খাবারই খায় না কেন তা লিভার হয়ে বা লিভারের মধ্য দিয়েই আমাদের রক্তে মিশ্রিত হয়ে শক্তি তৈরি করে। নইতো প্রতিদিনের যে ক্ষতি হয় সে গুলোকে পূরণ করে যখন খাবার গ্রহণ করি তখন কার্বোহাইড্রেট গুলো নিয়ে জমা রাখে। যখন আমরা না খেয়ে থাকবো বিশেষ করে রমজান মাসে তখন কিন্তু গ্লাইকোজেন অর্থাৎ যেটা আমরা জমিয়ে রেখে ছিলাম সে গুলোকে খরচ হিসাবে ধরে। শর্করাকে জমা রাখে। প্রয়োজনে একে ভাঙ্গে। রক্তের জমাট বাঁধে। কোয়াগুলেশন ফ্যাক্টর এর উপাদান গুলো তৈরি হয়। আরেকটি জিনিস তৈরি হয় সেটি হল অ্যালবুমিন। এটা আমাদের দেহের জন্য দরকারি না হলে আমাদের দেহে পানি চলে আসে। কিডনির কার্যক্ষমতা অনেক সময় লোপ পায়, বিলিরুবিন মেটাবলিজম করে, যেটা হবার কারণ ওর শরীরে বিলিরুবিন এর মাত্রা কমে গেলে।
এখন আসা যাক লিভার যখন তার কার্যপ্রক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয় তখন আমরা কোন কোন রোগে ভুগি………
লিভার যদি তার কাজ করতে ব্যর্থ হয় তখন আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সমস্যা হল………
- পেটে পানি চলে আসা।
- জন্ডিস হয় ।
- রক্ত আর জমাট বাঁধতে পারেনা।
- যে সমস্ত টক্সিন লিভার পরিশোধিত করত, সেগুলো মস্তিষ্কে চলে যায় তখন মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। এক পর্যায়ে কোমাতে চলে যায় মারাও যেতে পারে। এগুলো লিভার সিরোসিসের খুব বেশী জটিল অবস্থা।
- বিভিন্ন কারণে দেহের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি অক্ষম হয়ে যেতে পারে যা শরীরের জন্য খুবই খারাপ। লিভার দেহের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ যার কাজ হলো দেহে প্রবেশ করা টক্সিন বা বর্জ্য, রূপান্তর করে, ওই বর্জ্য মলের সঙ্গে বের হয়ে আসে।
- খাদ্যের সঙ্গে আমাদের দেহে প্রচুর পরিমাণে টক্সিন বা বিষক্রিয়া প্রবেশ করে থাকে। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লিভারের কর্মক্ষমতা কমে আসতে থাকে, অথবা কোন ভাইরাস রোগের কারণেও লিভারের কার্যক্ষমতা কমে আসে। ফলে দেহ থেকে যথাযথভাবে টক্সিন বের করে দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। তখন এসব ক্ষতিকর চর্বি হিসাবে জমা হয়। লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমা হলে ফেটি লিভার রোগ সৃষ্টি হতে পারে। লিভার প্রাকৃতিক ভাবে একটি চর্বিবহুল আর লিভারে সবসময়ই কিছু-না-কিছু চর্বি থাকা উচিত। ফ্যাটি লিভার রোগ হয় তখনই যখন লিভারের চর্বি এর নিজের অর্থাৎ মোট ওজনের ৫ থেকে ১০ শতাংশের বেশি হয়। যখন আপনার লিভার নিষ্কাশনে ভালোমতো কাজ করবে না তখন আপনি ওজন কমানোর জন্য যতই কম ক্যালরির খাবার খান না কেন যতই বেশি ব্যায়াম করুন না কেন কোনো কাজে আসবে না।
- লিভার মূলত চর্বি হজমের কাজ করে থাকে, আর যখন এটি ঠিকমতো কাজ করবেনা তখন চর্বিগুলো অন্ত্র থেকে লিভারে এসে জমা হবে।
আসুন জেনে নেওয়া যাক লিভার ভালো না থাকার শীর্ষ লক্ষণগুলো অর্থাৎ কোন কোন লক্ষণ গুলো দেখলে আমরা বুঝব আমাদের লিভারে সমস্যা হয়েছে্………
- ওজন হঠাৎ বেড়ে যাবে। যেহেতু চর্বি হজমের জন্য প্রধানত দায়ী সেটি যথাযথভাবে কাজ না করলে দেহে চর্বি জমতে শুরু করবে। যার ফলে ব্যাখ্যাতীত ভাবে আমাদের ওজন বেড়ে যাবে।
- লিভার এমন সব এলার্জির এন্টিবডি তৈরি করে যেগুলো অ্যালারজেন বা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান গুলোকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে। কিন্তু লিভারের কার্যক্ষমতা কমে গেলে ওই অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান গুলোকে আর ঠেকাতে পারে না।এর প্রতিক্রিয়ায় আবার দেহ হিস্টামিন উৎপাদন করতে থাকে যা অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী উপাদান গুলোকে সাহায্য করে। কিন্তু অতিরিক্ত উৎপাদন হলে আবার সেটা এলার্জির সাথে যুক্ত হয়ে চুলকানি এবং মাথাব্যথাকে দ্বিগুন করে তোলে।
- ক্রমাগত অবসাদ। দেহে টক্সিন জমা হলে তা মাংসপেশির বিভাগীয় প্রক্রিয়ায় বাধার সৃষ্টি করে, যা থেকে আবার ব্যথা এবং শারীরিক অবসাদ সৃষ্টি হতে পারে, ক্লান্তি থেকে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া মানসিক অবসাদ এর মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।
- লিভার ভালো না থাকার আরেকটি লক্ষন অতিরিক্ত ঘাম বের হওয়া। বেশি বেশি কাজ করার কারণে লিভারের কারয ক্ষমতা কমে যায় এবং সেটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তখন দেহের অন্যান্য অঙ্গের তা ছড়িয়ে দেয় এবং অতিরিক্ত ঘাম বের হবার মধ্য দিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করে।
- লিভারে জমা হওয়া চর্বি দেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। যা থেকে ত্বকে ব্রণ এর সৃষ্টি হতে পারে। কার্যক্ষমতা হারানো লিভারের কারণে সৃষ্ট ত্বকের এই সমস্যা ততক্ষন পর্যন্ত যাবে না যতক্ষণ না পুনরায় লিভারের কার্যক্ষমতা উন্নতি ঘটানো যাবে।
- তাছাড়াও দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস এটিও যকৃতের অক্ষমতার একটি লক্ষণ। মুখের স্বাস্থ্য ভালো থাকার পরেও যদি আপনার নিঃশ্বাসের সাথে দুর্গন্ধ বের হয় তাহলে বুঝবেন যে আপনার লিভারের কোন সমস্যা আছে। লিভারের স্বাস্থ্য ভালো না থাকার একটি লক্ষণ হলো দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস।
বন্ধুরা আমরা এতক্ষণ ধরে জানলাম কোন কোন কারন গুলো বা কোন কোন লক্ষণ গুলো আমরা সাধারণত লিভার অক্ষম হলে দেখতে পায়। অর্থাৎ কোন রোগ হলে এ ধরনের লক্ষণগুলো আমরা দেখতে পাই যা থেকে খুব সহজে আমরা বুঝতে পারবো আমাদের লিভার বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ধন্যবাদ।